রাস্তার ধারের সেই জাদুকরী ঘ্রাণ
বিকেল বেলা ঢাকার রাস্তায় হাঁটছেন, হঠাৎ নাকে একটা পোড়া মরিচ আর তেঁতুলের টক-মিষ্টি গন্ধ এল। আপনার পকেটে টাকা থাকুক বা না থাকুক, জিভে জল আসতে বাধ্য। এটাই বাংলাদেশি স্ট্রিট ফুডের ম্যাজিক। আমাদের দেশে স্ট্রিট ফুড বা রাস্তার খাবার শুধু ক্ষুধা মেটানোর বিষয় না, এটা একটা আবেগ, একটা কালচার, আর দিনশেষে বন্ধুদের সাথে আড্ডার প্রধান অনুষঙ্গ।
আজ আমরা ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আছি। আজকের স্ট্রিট ফুড কালচার আর ৯০ দশকের স্ট্রিট ফুড কালচারের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। একসময় যা ছিল শুধুই "অস্বাস্থ্যকর কিন্তু সুস্বাদু", আজ তা হয়ে উঠেছে "ট্রেন্ডি এবং ইনস্তাগ্রাম-যোগ্য"। আসুন, ডুব দেওয়া যাক আমাদের এই লোভনীয় খাবারের বিবর্তনের ইতিহাসে।
পর্ব ১: নস্টালজিয়া এবং ক্লাসিক যুগ (৯০ এবং ২০০০-এর দশক)
আমাদের ছোটবেলার স্ট্রিট ফুড ছিল খুব সাদামাটা কিন্তু আবেগে ভরপুর। তখন ফুড ভ্লগার ছিল না, ছিল না কোনো রেটিং সিস্টেম। ছিল শুধু বিশ্বাস আর স্বাদ।
১. স্কুল গেটের সেই রঙিন দিনগুলো
মনে আছে স্কুলের গেটে বসা সেই মামার কথা? যার কাছে কাঁচের বয়ামে রাখা থাকত লাল-নীল আইস ললি, আর পলিথিনে মোড়ানো আমশি, চালতা বা বরইয়ের আচার। ১ টাকা বা ২ টাকায় পাওয়া সেই আচারের স্বাদ আজকের ফাইভ স্টার হোটেলের ডেজার্টেও পাওয়া যাবে না। হাওয়াই মিঠাইওয়ালার ঘণ্টা বাজার শব্দ শুনলেই দৌড় দিতাম। তখন হাইজিন বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কেউ ভাবত না, ধুলোবালি মাখা সেই খাবারেই ছিল অমৃতের স্বাদ।
২. ফুচকা-চটপটি: অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজা
যুগ পাল্টাতে পারে, সরকার পাল্টাতে পারে, কিন্তু স্ট্রিট ফুডের সিংহাসন থেকে ফুচকা আর চটপটিকে কেউ নামাতে পারবে না। তবে এর ধরণ কিছুটা পাল্টেছে। আগে ছিল শুধুই তেঁতুলের টক। এখন এসেছে টক দই ফুচকা, নাগা ফুচকা, এমনকি চিজ ফুচকা। কিন্তু রাস্তার ধারের সেই টুলের ওপর বসে শালপাতার বাটিতে ফুচকা খাওয়ার ফিলিংসটা আজও একই আছে।
৩. ঝালমুড়ি আর মামার হাতের জাদু
লকডাউন হোক বা ট্রাফিক জ্যাম, বাসের জানালায় ঝালমুড়ির ঠোঙা এগিয়ে দেওয়া মামা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সরিষার তেলের ঝাঁঝ, লেবুর গন্ধ, আর মামার সেই স্পেশাল মশলা—ব্যাস, আর কী লাগে! ঝালমুড়ি শুধু খাবার না, এটা আমাদের টাইমপাসের সেরা সঙ্গী।
পর্ব ২: ফিউশনের অনুপ্রবেশ এবং কার্ট কালচার (২০১০-২০২০)
২০১০ এর পর থেকে ইন্টারনেটের প্রসারের সাথে সাথে আমাদের খাবারের রুচিতেও পরিবর্তন আসতে শুরু করে। মানুষ বুঝতে শেখে যে রাস্তার খাবার মানেই শুধু ভাজাপোড়া বা টক না।
১. ভেলপুরি থেকে পিৎজা-পুরি
হঠাৎ করেই আমরা দেখলাম রাস্তায় পিৎজা বিক্রি হচ্ছে। তবে ইতালিয়ান পিৎজা না, এটা আমাদের দেশি ভার্সন। রুটির ওপর সস আর চিজ দিয়ে ওভেনে বা কড়াইতে বানানো। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, খেতে কিন্তু মন্দ না। ভেলপুরির জায়গা দখল করতে শুরু করল এই ফিউশন আইটেমগুলো।
২. মোমোর বিপ্লব
একসময় মোমো ছিল শুধু চাইনিজ রেস্টুরেন্টের দামি খাবার। হঠাৎ করে বেইলি রোড, টিএসসি, আর মিরপুরের রাস্তায় ছোট ছোট স্টল বসলো। ২০ টাকার মোমো! চিকেন মোমো, বিফ মোমো, ফ্রাইড মোমো। নেপালি বা তিব্বতি এই খাবারটিকে আমরা পুরোপুরি বাংলাদেশি বানিয়ে ফেললাম প্রচুর ঝাল চাটনি দিয়ে। এখন তো মোমো ছাড়া ইভিনিং স্ন্যাক্স ভাবাই যায় না।
৩. ফুড কার্ট বা ভ্যান গাড়ির আধুনিকায়ন
আগে রাস্তার খাবার মানেই ছিল অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। কিন্তু গত এক দশকে "ফুড কার্ট" কালচার চালু হলো। ধানমন্ডি, খিলগাঁও, মিরপুরে সারিবদ্ধভাবে সাজানো সুন্দর লাইটিং করা কার্ট। সেখানে বার্গার, সাব-স্যান্ডউইচ, আর কফি বিক্রি হচ্ছে। যারা বিক্রি করছেন, তাদের অনেকেই ছাত্র বা শিক্ষিত তরুণ। স্ট্রিট ফুড ব্যবসা যে একটা স্মার্ট ক্যারিয়ার হতে পারে, এই ধারণাটা এখান থেকেই শুরু।
পর্ব ৩: ডিজিটাল যুগ এবং স্ট্রিট ফুড (২০২০-২০২৫)
এখনকার স্ট্রিট ফুড আর শুধু স্বাদের ওপর নির্ভর করে না, এটা নির্ভর করে "প্রেজেন্টেশন" বা দর্শনের ওপর।
১. ফুড ভ্লগিং-এর প্রভাব
"আসসালামু আলাইকুম হ্যালো এভরিওয়ান"—এই ডায়লগ শুনেই আমরা এখন বুঝি কোনো এক চিপার দোকানের খোঁজ পাওয়া গেছে। ফুড ভ্লগাররা আমাদের স্ট্রিট ফুড কালচারকে গ্লোবাল করে দিয়েছে। পুরান ঢাকার কোনো এক গলির বাখরখানি বা নিহারি এখন গুলশানের মানুষের কাছেও পরিচিত। ভ্লগারদের কারণে অনেক সাধারণ দোকানদার রাতারাতি সেলিব্রেটি বনে গেছেন।
২. ভাইরালের যুগে অদ্ভুত সব খাবার
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার জন্য কিছু অদ্ভুত ফিউশনও তৈরি হয়েছে। কোকাকোলা দিয়ে ফুচকা, ওরিও দিয়ে পকোড়া, বা ফান্তা দিয়ে ম্যাগি নুডলস! এগুলো খেতে কেমন সেটা পরের বিষয়, কিন্তু মানুষ কৌতূহলবশত ভিড় জমাচ্ছে। এটাকে বলা যায় "গিমিক ফুড কালচার"।
৩. ক্যাশলেস পেমেন্ট
২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে এখন রাস্তার ধারের ফুচকাওয়ালা মামাও কিউআর কোড (QR Code) ব্যবহার করছেন। পকেটে টাকা নেই? সমস্যা নেই, বিকাশে বা নগদে পেমেন্ট করে দিন। এই ডিজিটাল অ্যাডাপশন স্ট্রিট ফুড ইন্ডাস্ট্রিকে আরও অর্গানাইজড করেছে।
পর্ব ৪: এলাকা ভিত্তিক বৈচিত্র্য
বাংলাদেশের স্ট্রিট ফুড মানেই যে এক রকম, তা কিন্তু না। এলাকা ভেদে এর স্বাদ বদলায়।
পুরান ঢাকা: এখানকার স্ট্রিট ফুড মানেই হেভি খাবার। সকালের নাস্তায় বাকরখানি, দুপুরে হাজীর বিরিয়ানি (যদিও এখন রেস্টুরেন্ট, কিন্তু শুরুটা স্ট্রিট থেকেই), আর রাতে লাচ্ছি বা বিউটির শরবত। পুরান ঢাকার স্ট্রিট ফুডে মুঘল আমলের একটা রাজকীয় ছাপ আছে।
টিএসসি এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা: এখানে খাবার হতে হবে সস্তা এবং আড্ডার উপযোগী। রং চা, চপ, সিঙ্গারা, আর খিচুড়ি। টিএসসিতে বসে ৫ টাকার চা আর ১০ টাকার চপ খাওয়ার স্মৃতি নেই এমন ছাত্র খুঁজে পাওয়া ভার।
চট্টগ্রাম: এখানকার স্ট্রিট ফুডে মেজবানি ফ্লেভার আর শুঁটকির ঝাল থাকে। বারো ভাজা বা চট্টগ্রামের স্পেশাল দুরুজ কুলি পিঠা রাস্তার ধারে খাওয়ার মজাই আলাদা।
সিলেট: সাতকড়ার আচার দেওয়া ফুচকা বা সিলেটের স্পেশাল চা—স্ট্রিট ফুডেও সিলেটের নিজস্বতা বজায় আছে।
পর্ব ৫: হাইজিন এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা
সত্যি বলতে, স্ট্রিট ফুড নিয়ে আমাদের প্রধান ভয় ছিল স্বাস্থ্য। কিন্তু এখন দৃশ্যপট পাল্টাচ্ছে। অনেক কার্টে এখন গ্লাভস এবং হেয়ারনেট ব্যবহার করা হয়। "মিনারেল ওয়াটার" দিয়ে ফুচকা বানানোর ট্রেন্ড চালু হয়েছে। মানুষ এখন ২ টাকা বেশি দিয়ে হলেও পরিষ্কার খাবার খেতে চায়। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অভিযানের ফলেও সচেতনতা বেড়েছে।
উপসংহার: আবেগের আরেক নাম
বাংলাদেশের স্ট্রিট ফুড শুধু ক্ষুধা নিবারণ নয়, এটি সামাজিক মেলবন্ধনের এক অদ্ভুত জায়গা। রাস্তার ধারের ওই টংয়ের দোকানেই একজন কোটিপতি বিএমডব্লিউ থেকে নেমে চা খাচ্ছেন, তার পাশেই রিকশাচালক মামা বিড়ি ধরাচ্ছেন। এখানে কোনো ভেদাভেদ নেই।
আমাদের স্ট্রিট ফুড বিবর্তিত হয়েছে, এবং আরও হবে। রোবোটিক শেফ হয়তো কোনোদিন আমাদের ফুচকা বানিয়ে খাওয়াবে, কিন্তু "মামা, ঝাল একটু বেশি দিয়েন"—এই আবদারটা কোনোদিন রোবট বুঝবে না। এই আন্তরিকতাই আমাদের স্ট্রিট ফুডকে বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে আলাদা করেছে। ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা থেকে শুরু করে ঠাণ্ডা লাচ্ছি—এই বৈচিত্র্যই আমাদের গর্ব।
তাই আজই বেরিয়ে পড়ুন, ডায়েট কালকের জন্য তোলা থাক, আজ হোক মন ভরে খাওয়া!